হেরোইন কি ? - প্রযুক্তির আলোয় * আলোকিত জগৎ | The whole technology of light | প্রযুক্তির আলোয় * আলোকিত জগৎ | The whole technology of light

হেরোইন কি ?

Print this post

আফিমের ইতিহাস অনেক লম্বা। খ্রিস্টপূর্ব ৩ হাজার ৪ বছর আগে নিম্ন মেসোপটেমিয়ায় (বর্তমান ইরাক) আফিম চাষ হতো বলে জানা গেছে। পরবর্তীতে সুমেরীয় ও আসিরীয়রাও আফিম চাষ করে। আসিরীয়দের কাছ থেকে আফিম আসে ব্যাবিলনীয়দের হাতে এবং তাদের কাছ থেকে আফিমতত্ত্ব গ্রহণ করে মিসরীয়রা। তখন অবশ্য আফিম হেরোইনে রূপান্তর হতো না। যেদিন থেকে আফিম হেরোইনে রূপ নেয়া শুরু করল সেদিন থেকে আফিম বিশ্বে মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াল। সুমেরীয়রা আফিমকে চিনত ‘আনন্দের গাছ’ (Hul Gil) হিসাবে। সেই আফিম এখন ‘প্রাণনাশক’ বলে পরিচিত।
জাতিসংঘের গবেষণা বলছে, প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ৫ হাজার মেট্রিক টন আফিম  অথবা ৫শ টন হেরোইন উৎপাদন হয়। এর মাত্র ২০ শতাংশই আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে ধরা পড়ে, বাকি ৪শ টন চলে যাচ্ছে হেরোইন আসক্তদের হাতে। ইউরোপের রাস্তায় যার মূল্য ৩০ থেকে ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং যুক্তরাষ্ট্রে ৪০ থেকে ৮০ বিলিয়ন ডলার। জাতিসংঘের ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম (ইউএনওডিসি) বিভাগ জানিয়েছে (২০১০), বর্তমানে বিশ্বের ১শ ৫০ লাখেরও বেশি মানুষ আফিম থেকে উৎপাদিত নেশাদ্রব্য ক্রয় করে। এর চতুর্থাংশ হেরোইনসেবী প্রায় ১ হাজার ১শ মেট্রিক টনের মতো আফিম কেনে। বাকিরা প্রতিবছর প্রায় ৩শ ৪০ মেট্রিক টন বিশুদ্ধ হেরোইন ক্রয় করে। বিশ্বে প্রায় ৩ হাজার ৭শ মেট্রিক টন আফিম থেকে উৎপাদিত নেশাদ্রব্যের চাহিদা রয়েছে।
হেরোইন এক ধরনের শক্তিশালী পেইনকিলার। এটি সিনথেটিক (রাসায়নিক প্রণালীতে কৃত্রিমভাবে উৎপাদিত) হতে পারে, সেমি-সিনথেটিক হতে পারে, এমনকি সিনথেটিক নাও হতে পারে। তবে মূলত এটি আসে আফিম ফুলের (opium poppy) শুকনো সাদা দুধ থেকে, এই আঠা জতীয় পদার্থ থেকে মরফিন ও কোডিনও (codeine) উৎপাদন করা হয়। স্ম্যাক, বিগ এইচ, কাবালা (স্পেনিশ), ব্ল্যাক টার, এইট বল, জাঙ্ক, টিএনটি ইত্যাদি হেরোইনের জনপ্রিয় ছদ্মনাম। হেরোইন সরাসরি ওষুধ হিসাবে ব্যবহৃত হয় না, এটি মরফিনের বিশুদ্ধ সংস্করণ। তাই চিকিৎসাবিজ্ঞানে হেরোইন ডায়ামরফিন (diamorphine) হিসাবে পরিচিত। ১৮৭৪ সালে প্রথম মরফিন থেকে রাসায়নিক উপায়ে হেরোইন বের করা হয় এবং ওষুধ হিসাবে ব্যবহারের জন্য ১৮৯৮ সালে প্রথম তা বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করা হয়। ১৯৯০ সালের শুরু থেকেই এটি চিকিৎসাশাস্ত্রে  ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হওয়া শুরু করে। ১৯১৪ সালে হেরোইনকে হ্যারিসন নারকোটিক অ্যাক্ট দিয়ে হেরোইনের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে আনা হয়।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে হেরোইন আসে। চীন, মেক্সিকো, ইরান, পাকিস্তান, আফগানিস্তান প্রভৃতি দেশে হেরোইন উৎপাদন করা হয়। আফিম গাছ শুষ্ক স্থানে ভালো জন্মে। আফিম চাষিরা ছোট ছোট জমিতে আফিম চাষ করে থাকে। চাষিরা মূলত হেরোইন উৎপাদন করে না। তারা কাঁচামাল সরবরাহ করে। আফিমের সাদা দুধকে প্রথমে মরফিনে রূপান্তর করা হয়। অ্যাসিটিক অ্যানহাইড্রাইড (acetic anhydride) রাসায়নিক দিয়ে মরফিনকে হেরোইনে রূপান্তর করা হয়।
বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বহু রূপে হেরোইন পাওয়া যায়। কিন্তু হেরোইনের সাদা পাউডারটাইই (মরফিনের বিশুদ্ধ সংস্করণ) সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে এবং এটিকে আসল হেরোইন বলা হয়। সাদা ছাড়াও বিভিন্ন রঙের হেরোইন পাওয়া যায়, সাদা থেকে কালচে বাদামি। আরেক ধরনের হেরোইন রয়েছে, ‘মেক্সিকান মাড (mud)’ বা ‘বস্ন্যাক টার (tar)’ হেরোইন, যা যুক্তরাষ্ট্রে বেশি জনপ্রিয়।

শরীরে হেরোইনের প্রভাব


নেশাদ্রব্য হিসাবে হেরোইন যেমন দ্রুত কাজ করা শুরু করে তেমনি শরীরের শত্রু হিসাবেও হেরোইন করিৎকর্মার মতো কাজ করে। হেরোইন সেবনের সূচনাকাল থেকেই তা শরীরে ভয়ানক প্রভাব ফেলা শুরু করে। হেরোইন সরাসরি শরীরের কেন্দ্রীয় স্নায়বিক সিস্টেমকে আঘাত করে। হেরোইন শরীরে পাঁচ ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ১. স্বল্পমেয়াদি, ২. দীর্ঘমেয়াদি, ৩. অতিরিক্ত গ্রহণের প্রতিক্রিয়া, ৪. আসক্তি ও ৫. ছেড়ে দেওয়ার পরের প্রভাব।
স্বল্পমেয়াদি প্রভাবের মধ্যে রয়েছে হেরোইন সেবনের পরপরই এক ধরণের অস্থায়ী আনন্দ পাওয়া যায়, ত্বক লাল ও গরম হয়, মুখ শুকিয়ে যায় এবং হাত-পা ভারী অনুভব হয়। এ সময় মস্তিষ্ক সঠিকভাবে কাজ করে না এবং শ্বাস-প্রশ্বাস ও হৃদস্পন্দনের গতি ধীর হয়ে আসে।
হেরোইন গ্রহণ, গ্রহণ পদ্ধতি এবং সেবনের সরঞ্জাম শরীরে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। যেহেতু একই সরঞ্জাম একাধিক ব্যবহারকারী ব্যবহার করে এবং সাবধানতা অবলম্বন করে না সেহেতু শরীরে ইনফেকশন তৈরি হয়, বিশেষ করে হৃদনালীতে। যকৃতের রোগও দেখা দিতে পারে (যেমন : হেপাটাইটিস ‘সি’)। কিডনি ও ফুসফুসের রোগ এবং চামড়ায় ইনফেকশন দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব হিসাবে দেখা দিতে পারে। আর এইচআইভি ভাইরাস ও অন্যান্য রক্তবাহিত রোগের ঝুঁকি তো রয়েছেই। ইউএনওডিসি তথ্যমতে, মধ্য এশিয়া (তাজিকিসত্মান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, কিরগিস্তান ও কাজাখস্তান), ইউক্রেন ও রাশিয়ার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ লোকের এইচআইভি পজিটিভ হওয়ার পেছনে আফিমের হাত রয়েছে।
অতিরিক্ত (ওভারডোজ) হেরোইন সেবনের ফলে সেবনকারীর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। অতিরিক্ত ডোজ হৃৎপিন্ড কিংবা ফুসফুসের ক্রিয়া বন্ধ করে দিতে পারে। খুচরা ক্রেতার হাতে পৌঁছানোর আগে হেরোইনে ভেজাল বস’ হিসাবে অনেক কিছু মেশানো হয়। অনেক ধরনের বিষও মেশানো হয়। এই ভেজালের কারণেও সেবনকারীর মৃত্যু ঘটতে পারে।
ব্যবহারকারীরা হেরোইনের প্রতি তীব্রভাবে আসক্ত হয়ে পড়ে, যা শরীরের জন্য ভয়াবহ ফল বয়ে আনে। ব্যবহারকারীরা হেরোইন গ্রহণের তথাকথিত আনন্দ বারবার পেতে চায়। তারা ধীরে ধীরে শারীরিকভাবে হেরোইনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ফলে শারীরিক ও মানসিকভাবে তারা বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ে।
হেরোইন এমন শক্তিশালী নেশাদ্রব্য যে তা ছেড়ে দেওয়ার পরও ব্যবহারকারীরা এর নেতিবাচক প্রভাব থেকে সহসা রেহাই পায় না। হেরোইন পেতে তারা উগ্র হয়ে ওঠে। অনিদ্রা, অসি’রতা ও অস্বস্তি তাদের ঘিরে থাকে। বমি হওয়া থেকে শুরু করে পেশি ও হাড়ের ব্যথা শুরু হয়।

হেরোইন গ্রহণ


মাদকাসক্তরা বিভিন্ন উপায়ে হেরোইন গ্রহণ করে থাকে। এর মধ্যে তিনটি উপায় বেশি প্রচলিত। ১. ইঞ্জেকশন, ২. ধূমপান এবং ৩. নাক দিয়ে গ্রহণ। হেরোইন সহজে গলে না। তা ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে নিতে হলে ব্যবহারকারীরা হেরোইন ধাতুর চামচে নিয়ে পানি যোগ করে। তারপর চামচটিকে আগুনের ওপর রেখে দ্রবণ তৈরি করে। শেষে দ্রবণটি ইঞ্জেকশনে ভরে। কেউ শিরায় ইঞ্জেকশন ঢোকায়, কেউবা শুধু চামড়ার নিচেই হেরোইন ছেড়ে দেয়। হেরোইন ধূমপান করতে হেরোইন আসক্তরা হেরোইন পাউডার একটি ফয়েল পেপারের মধ্যে রেখে গরম করে, এতে যে উদ্বায়ী পদার্থ তৈরি হয় তা তারা একটি নলের মাধ্যমে মুখ দিয়ে টেনে নেয়। আর নাক দিয়ে যারা হেরোইন গ্রহণ করে তারা কোনো আয়োজন ছাড়াই সরাসরি পাউডার নাক দিয়ে টেনে নেয়। যারা প্রথম উপায়টি গ্রহণ করে, তারা হেরোইন গ্রহণের মাত্র ৭-৮ সেকেন্ডের মধ্যে ফল পেয়ে যায়। কেননা তখন হেরোইন রক্ত ও মসিত্মষ্কের মধ্যকার সীমা ভেঙে ফেলে। মস্তিষ্কে হেরোইন মরফিন হয়ে কাজ করে। তখন ব্যবহারকারী এক ধরনের উচ্চমাত্রার আবেশ অনুভব করে, ত্বকের তাপমাত্রা বেড়ে যায়, মুখ শুকিয়ে যায় এবং হাত-পা ভারি লাগা শুরু হয়। পাশাপাশি তার বমি ভাব, শরীরে দুর্বল লাগা এবং চুলকানি অনুভব হতে পারে। হেরোইন গ্রহণের কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত ব্যবহারকারী এ আবেশে থাকে এবং হৃদস্পন্দন ও শ্বাস-প্রশ্বাস ধীরগতির হয়। নেশা কেটে যাওয়ার কিছু সময় পরই ব্যবহারকারী ফের হেরোইন নিতে আগ্রহ প্রকাশ করে।
হেরোইন গ্রহণের পরের দুটো উপায় বিশ্বজুড়ে তার আবেদন হারাচ্ছে, কেননা পরের উভয় উপায়ে হেরোইন গ্রহণ করলে তার ফল পাওয়া যায় ১০ থেকে ১৫ মিনিট পর।

হেরোইনের দরদাম


ইউএনওডিসির তথ্য মতে, ২০০৮ সালে আফগানিসত্মানে এক গ্রাম হেরোইনের পাইকারি মূল্য ছিল ২ দশমিক ৪ মার্কিন ডলার, তাজিকিস্তানে ৩, পাকিস্তানে ৩ দশমিক ১, ইরানে ৩ দশমিক ২, মিসরে ৭ দশমিক ৪ (গড়পড়তা), সিরিয়ায় ১১, তুরস্কে ১১ (গড়পড়তা), টোগোয় ১৫ দশমিক ৭, উজবেকিস্তানে ১৬, জর্দানে ১৮ দশমিক ২, বসনিয়া-হারজেগোভিনায় ১৯ দশমিক ১, ইসরায়েলে ২৪, সার্বিয়ায় ২৬ দশমিক ৫, গ্রিসে ৩০, মলদোভায় ৩৫, ইউরোপের অন্যান্য দেশে ৪৫ (গড়পড়তা), সৌদি আরবে ৪৫ দশমিক ৩, রাশিয়ায় ৪৫ দশমিক ৯, হংকং ও চীনে ৪৯ দশমিক ৭, মিয়ানমারে ৭০ দশমিক ৬, ইন্দোনেশিয়ায় ৮৭ দশমিক ৪, বাহরাইনে ২৪০, কলম্বিয়ায় ১০, ইকুয়েডরে ১৩, মেক্সিকোতে ৩৫, গুয়াতেমালায় ৫৩ এবং কানাডায় ১১৯ মার্কিন ডলার (প্রতিগ্রাম)। যুক্তরাষ্ট্রে মেক্সিকোর ১ গ্রাম ‘টার’ হেরোইনের পাইকারি মূল্য ২১ এবং দড়্গিণ আমেরিকান হেরোইনের মূল্য ৫৮ মার্কিন ডলার।

আফগানিস্তান


আফগানিস্তান বর্তমানে বিশ্বের ৯০ শতাংশ আফিম উৎপাদন এবং ৮৫ শতাংশ হেরোইন ও মরফিন তৈরি করে। ২০১০ সালের ২৮ মে রুশ প্রেসিডেন্টের বিশেষ প্রতিনিধি আনাতোলি সাফোনোভ বলেছিলেন, ‘আফগানিস্তানের মাদক সমস্যা দূর না করে দেশটির কোনো সমস্যারই সমাধান করা যাবে না।’ আফগানিস্তানের মাদক সমস্যা কতটা প্রকট এ মন্তব্য থেকে কিছু আঁচ করা যায়। রাশিয়ার পক্ষ থেকে আরো আশঙ্কা করা হয়েছে, আফগানিস্তানের মাদকদ্রব্য উৎপাদন বিশ্ববাসীর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ এবং আফগানিস্তান থেকে আফিম পাচার বিশ্বশান্তির জন্য হুমকি। ইউএনওডিসি জানায়, জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো অনুধাবন করেছে, আফগান আফিম বিশ্ববাসীর জন্য একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ। এ কারণে ২০১৯ সালের মধ্যে একটি সনেত্মাষজনক ইতিবাচক ফল পেতে রাষ্ট্রগুলো তাদের আফিম ও হেরোইনবিরোধী কার্যক্রম আরো জোরদার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
১৯৭৯ সালে রাশিয়া আফগানিস্তান দখল করে। ১৯৮০ সালের দিকে তৎকালীন গেরিলা দল মুজাহিদিন বেশি বেশি আফিম চাষ শুরু কিংবা চাষিদের আফিম চাষ করতে বাধ্য করে। আফিম বিক্রির অর্থ তারা রুশ বাহিনী এবং স্থানীয় সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যয় করত। ইউএনওডিসি ২০১০ সালের ২১ জুন ‘আফগানিস্তানে মাদকের ব্যবহার’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা গেছে, ১৫ থেকে ৬৪ বছরের প্রায় ১০ লাখ আফগান মাদকাসক্ত (মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশ)। অনেক আফগান স্রেফ কঠোর জীবনযাপন থেকে বাঁচতে মাদকাসক্ত হয়। আফগানিস্তানে এক কিলোগ্রাম আফিমের দাম ২৫ থেকে ১শ ২৫ মার্কিন ডলার। জাতিসংঘ জানিয়েছে, তালেবানরা আফিম ব্যবসা করে বছরে প্রায় ৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করে। আল কায়দার অর্থের অন্যতম উৎস আফগান আফিম। দ্য ওয়াশিংটন টাইমস পত্রিকার ভাষ্য, আন্তর্জাতিক মাদক পাচারের সঙ্গে আল কায়দা গভীরভাবে জড়িত বলে জানিয়েছে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের একজন কর্মকর্তা। তিনি আরো জানান, আল কায়দা বিশেষ করে হেরোইন ও হাশিশের অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত এবং তারা এই ব্যবসা থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র ও পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম ক্রয় করে (২৯ ডিসেম্বর, ২০০৩)। ইউএনওডিসি (২০১০) জানিয়েছে, আফগানিস্তানের হেরোইন পাচারের বিভিন্ন রুটে আল-কায়দা ও অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের ( যেমন, ইসলামিক মুভমেন্ট অব তুর্কিস্তান এবং তেহরিক-ই-তালেবান) ক্যাম্প রয়েছে। সংগঠনগুলো হেরোইন পাচার থেকে লাভবান হয়।
আফগান হেরোইন ব্যবসায়ীরা বিশ্বজুড়ে বছরে প্রায় ২শ বিলিয়ন ডলারের খুচরা ব্যবসা করে। পশ্চিম ইউরোপের মাদকাসক্তরা আফগান হেরোইনের পেছনে বছরে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে। ইউএনওডিসি জানিয়েছে, ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা ১২ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। সংস্থাটি আরো জানিয়েছে, ২০০৫ সালে বিশ্বের ১১ মিলিয়ন হেরোইনসেবীসহ অন্য নেশাগ্রস্তরা প্রায় ৬৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। ২০০৭ সালে আফগানিস্তানে আফিমের উৎপাদন বেড়েছে ৩২ শতাংশ (১ বিলিয়ন ডলার)। ’৯০ দশকের গোড়া থেকেই আফগানিস্তানে বাণিজ্যিকভাবে আফিম উৎপাদন শুরু হয়, বিশেষ করে তালেবান সরকারের পতনের পর। ২০০৭ সালে এসে আফগান আফিম চাষ ভয়াবহ আকার ধারণ করে, এ সময় প্রায় ১ লাখ ৯৩ হাজার হেক্টর জমিতে আফিম চাষ করা হয়, যা আফগানিস্তানের মোট ফসলি জমির ৬৯ শতাংশ। একই বছর এর ৩৪ শতাংশ কমে আসে, ফলে আফগানিস্তানের আফিম উৎপাদন ৮ হাজার ২শ মেট্রিক টনে গিয়ে দাঁড়ায়। এরপরও বিশ্বের প্রায় ৯৩ শতাংশ আফিম আফগানিস্তান  তথা অসাধু ব্যবসায়ীরা একাই উৎপাদন করে। আফগানিস্তান বিশ্বের সবচেয়ে বড় আফিম উৎপাদক ও রফতানিকারক দেশ। আবার একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ক্রেতাও। ২০০৮ সালে বিশ্বের ৭ শতাংশ (৮০ মেট্রিক টন) আফিম দেশটিতে ঢুকেছে। তখন দেশটিতে হেরোইনসেবীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৫০ হাজার (২০০৯ সালে তা ২ লাখ থেকে আড়াই লাখে দাঁড়িয়েছে)। ২০০৮ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশটির হেরোইন ব্যবসায়ীরা বছরে ২ মেট্রিক টন হেরোইন কেনে। আফগান সেনাদের মধ্যেও হেরোইন গ্রহণের প্রবণতা বাড়ছে বলে জানিয়েছে ব্রিটেনের দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকা (২০০৯)। আফগানিস্তানের আশপাশের দেশেও হেরোইনসেবীদের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। ইরান, পাকিস্তান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান ও তুর্কমেনিস্তানে বছরে প্রায় ৬শ ৫০ মেট্রিক টন আফিম ঢোকে, যা বিশ্বের আফিম ক্রয়ের ৬০ শাতাংশ। ১৯৮০ সালে আফগানিস্তান ২শ মেট্রিক টন আফিম উৎপাদন করে, ২০০৯ সালে এসে সে পরিমাণ ৬ হাজার ৯শতে উন্নীত হয়। ২০০৮ সালে দেশটির ২ হাজার ৭শ মেট্রিক টন আফিমকে ৩শ ৮০ মেট্রিক টন হেরোইনে রূপান্তর করা হয়েছে।
আফগানিস্তানে প্রধানত ৩ ধরনের আফিম পাওয়া যায়, ১. স্পিন (spin), ২. বারানি (barani) ও ৩. সুর (sur)। প্রথম দুটি নিম্নমানের আফিম। অতিরিক্ত পানির যে আফিম মান হারিয়েছে সেগুলোকে এই নামে শ্রেণীকরণ করা হয়। সুর (অর্থ : লাল) আফিম দুটি রঙে পাওয়া যায়, কালচে লাল ও বাদামি। সুর উচ্চমানসম্পন্ন হওয়ায় আগের দুটির চেয়ে এর দাম দ্বিগুণ। অন্যান্য মানের আফিমের মধ্যে তোর (tor) ও জারও (jar) রয়েছে। আফগানিস্তানের দড়্গিণাঞ্চলে তোর (অর্থ : কালো) সবচেয়ে ভালো, আর জার (অর্থ : হলুদ) সবচেয়ে নিম্নমানের আফিম হিসাবে স্বীকৃত।
রফতানির আগে আফগানিসত্মানে উৎপাদিত ৩ ভাগের ২ ভাগ অফিম হেরোইন বা মরফিনে রূপান্তর করা হয়। ৭ কিলোগ্রাম আফগান আফিম দিয়ে ১ কিলোগ্রাম মরফিন অথবা ১ কিলোগ্রাম ব্রাউন হেরোইন বানানো হয়। আফিমকে হেরোইনে রূপান্তরের কাজটি আগে মূলত আফগানিস্তানের প্রতিবেশী দেশগুলোতে সংঘটিত  হতো। যেমন পাকিস্তান, ইরান ও তুরস্ক। কিন্তু বর্তমানে বহু অবৈধ ল্যাবরেটরি স্থাপনের মাধ্যমে দেশটি এখন বিশ্বের অন্যতম প্রধান হেরোইন উৎপাদক দেশ।

মেক্সিকো


আফিম উৎপাদনের দিক থেকে মেক্সিকোর অবস্থান তৃতীয় (মিয়ানমারের পর)। ১৯৯০ সালের দিকে কলম্বিয়ার মাদক ব্যবসায়ীদের একটি বড় অংশ নির্মূল হলে মেক্সিকোর মাদক ব্যবসায়ীরা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ২০০৮ সালে মেক্সিকোতে আফিম উৎপাদন বেড়েছে ১শ ২০ শতাংশ। দেশটি আগে যেখানে বছরে ২০ থেকে ৩০ মেট্রিক টন আফিম উৎপাদন করত সেখানে এখন প্রায় ৩শ ২৫ মেট্রিক টন উৎপাদন করে। বর্তমানে মেক্সিকান মাদক ব্যবসায়ীরা যুক্তরাষ্ট্রের পাইকারি মাদক বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। মেক্সিকো এখন পৃথিবীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাদক উৎপাদক ও পাচারকারী দেশ। মেক্সিকো হেরোইন উৎপাদন করে কম, কিন্তু হেরোইন সরবরাহ করে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বড় অংশের চাহিদা পূরণ করে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৭০ শতাংশ নেশাদ্রব্য মেক্সিকো একাই সরবরাহ করে। লাতিন আমেরিকার চাহিদাও মেক্সিকান ও কলম্বিয়ান হেরোইন ব্যবসায়ীরা পূরণ করে। মেক্সিকো বিভিন্ন ধরনের হেরোইন উৎপাদন করে। এর মধ্যে ব্ল্যাক টারের চাহিদা ব্যাপক। যদিও এটি এক সময় এশিয়া ও কলম্বিয়ার হেরোইনের তুলনায় নিম্নমানের ছিল। ২০০৮ সালে মেক্সিকো ও কলম্বিয়াসহ লাতিন আমেরিকা ৩০ থেকে ৪০ মেট্রিক টন হেরোইন উৎপাদন করেছে। একই বছর মেক্সিকো একাই প্রায় ৩৮ মেট্রিক টন হেরোইন তৈরি করেছে।

হেরোইনের বিশ্ববাজার


বর্তমানে বিশ্বে বছরে যে পরিমাণ হেরোইন ও আফিম উৎপাদিত হয় তার পাইকারি বাজার দর যথাক্রমে প্রায় ৫৫ এবং ৭ থেকে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। দুটো মিলিয়ে বাজার দর বার্ষিক প্রায় ৬৫ বিলিয়ন ডলার। এ অঙ্ক অনেক দেশের বার্ষিক আয়ের চেয়ে বেশি।
মূলত পৃথিবীর তিনটি অঞ্চলে আফিম উৎপাদন হয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া (প্রধানত মিয়ানমার), দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া এবং লাতিন আমেরিকা (মেক্সিকো ও কলম্বিয়া)।
এশিয়ায় আফিম ক্রয় বেশি হয়। কেননা এশিয়ায় আফিমের একটি ঐতিহ্য রয়েছে। এশিয়ার এ অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা বছরে প্রায় ১৮ মেট্রিক টন হেরোইন কেনে। গত শতক থেকে ধারাবাহিকভাবে আফিম শক্তিশালী হেরোইনে রূপ নিয়েছে। ইরান, পাকিস্তান ও ভারতের মতো দেশে আফিম নিজের একটি বড় বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। যাহোক, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও লাওসকে হেরোইন ব্যবসার গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল বলা হয়। দক্ষিণ-পূর্ব ও পূর্ব এশিয়ায় যত আফিম আসে তার প্রধান সরবরাহকারী মিয়ানমার। কিছু অংশ সরবরাহ করে লাওস (গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র)। দক্ষিণ-পূর্ব ও পূর্ব এশিয়ার কিছু কিছু দেশে আফিম চাষ হয় বলে অনুমান করা হয়। এসব দেশে যে মিয়ানমার ও লাওস থেকে আফিম আসে তার বেশকিছু প্রমাণ মিলেছে। দেশ দুটি মিলে ২০০৮ সালে ৪০ মেট্রিক টন হেরোইন তৈরি করেছে, যার পুরোটাই মিয়ানমারে রিফাইন হয়। মিয়ানমারে উৎপাদিত প্রায় ৪০ মেট্রিক টন (বার্ষিক) হেরোইনের ৪ ভাগের এক ভাগ স্থানীয় ও আঞ্চলিক (প্রধানত চীন) বাজারে যায়। বাকিটা যায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও মহাসাগরীয় দেশগুলোতে।
এ অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি অফিম উৎপাদন করে মিয়ানমারের হেরোইন ব্যবসায়ীরা। ১৯৭০ ও ১৯৮০ সালের দিকে মিয়ানমার ছিল বিশ্বের প্রধান আফিম উৎপাদক। মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও লাওসের আফিম থাইল্যান্ড থেকে সমুদ্রপথে হংকং অথবা তাইওয়ানে পৌঁছায়। সেখানে আফিম হেরোইনে রূপান্তরিত হয়। সেখান থেকে জাহাজে করে যায় যুক্তরাষ্ট্রে। চীনে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গলের আফিম পাচার হয় এবং হেরোইনে রূপান্তর হয়। চীনা ব্যবসায়ীদের আফিম ক্রয়ের পরিমাণ অনেক কমে এসেছে। তবু বছরে প্রায় ১২ মেট্রিক টন আফিম ক্রয় করে। চীনে প্রায় ২২ লাখ হেরোইনসেবী রয়েছে। চীনে ২০০৮ সালে প্রায় ৪৫ মেট্রিক টন হেরোইন ঢুকেছে। চীনের সিংহভাগ হেরোইন আসে মিয়ানমার ও আফগানিস্তান থেকে। সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় মাদকবিরোধী শক্ত আইন থাকা সত্ত্বেও গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গলের হেরোইন দেশ দুটোতে দেদার ঢুকে পড়ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের হেরোইন চাহিদার প্রায় অর্ধেকই পূরণ করত দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার ইরান, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান। তিনটি দেশকে একত্রে হেরোইন ব্যবসার ‘গোল্ডেন ক্রিসেন্ট’ বলা হয়। যদিও বিশ্বের প্রধান হেরোইন উৎপাদক দেশ ইরানে সম্প্রতি হেরোইন ক্রয়ের হার কমেছে (৩ লাখ ৯১ হাজার হেরোইনসেবীর জন্য বছরে ১৪ মেট্রিক টন)। ধারণা করা হয়, গোল্ডেন ক্রিসেন্টের সিংহভাগ হেরোইন এখন সমুদ্র পথে ইউরোপে যায়। যুক্তরাষ্ট্রে কিছু অংশ যায়।
যদিও যুক্তরাষ্ট্রের চাপের কারণে পাকিস্তান আফিম চাষ বন্ধ করতে দৃশ্যত অনেকাংশেই সফল হয়েছে। তারপরও চীন, উপসাগরীয় দেশ এবং পূর্ব ও দড়্গিণ আফ্রিকান দেশগুলোতে হেরোইন পাচারের জন্য পাকিস্তানি বন্দরগুলো (বিশেষত করাচি) প্রধান ভূমিকা রাখছে। শুধু করাচি থেকেই বছরে ১১ মেট্রিক টন হেরোইন সংযুক্ত আরব আমিরাতে (বেশিরভাগই দুবাইতে) পাচার হয়। পাকিস্তান প্রায় ২৫ মেট্রিক টন হেরোইন পাঠায় এশিয়ার অন্যান্য দেশে। ২০০৬ সালের তথ্য অনুযায়ী পাকিস্তানে প্রায় ৫ লাখ হেরোইন আসক্ত রয়েছে। ২০০৮ সালে দেশটিতে ১৯ মেট্রিক টন হেরোইন এবং বছরে ৮০ মেট্রিক টন আফিম ঢোকে। গোল্ডেন ক্রিসেন্টের আরেক সদস্য ইরানও আফিম চাষ রোধে পদক্ষেপ নিয়েছে। ইরানের মাদক ব্যবসায়ীরা এখন আফগানিস্তান থেকে হেরোইন আমদানি করে। দেশটি এখন বছরে প্রায় ৪শ ৫০ মেট্রিক টন আফিম কেনে। দক্ষিণ-পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ায় উৎপাদিত আফিম সমুদ্রপথে তুরস্কে যায়। সেখানকার গোপন গবেষণাগারে আফিম হেরোইনে বদল হয়। এশিয়ায় উৎপাদিত প্রায় শতভাগ হেরোইন তুরস্ক হয়ে বলকান রুট দিয়ে ইউরোপে পৌঁছায় (পূর্ব ইউরোপে ৪ দশমিক ৪, দক্ষিণ ইউরোপে ২ দশমিক ৪ এবং পশ্চিম ও মধ্য ইউরোপে ৮০ মেট্রিক টন)। বলকান রুটের উত্তরের শাখাপথ  দিয়ে হেরোইন রুমানিয়া, হাঙ্গেরি, চেক ও স্লোভাকিয়া পৌঁছে। ২০১০ সালের জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ দপ্তর (ইউএনওডিসি) তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বলকান রুট হলো হেরোইন পাচারের প্রধান ট্রানজিট (যার ওপর দিয়ে অন্য স্থানে পৌঁছানো যায়)। দক্ষিণের শাখাপথ দিয়ে এই হেরোইন ক্রোয়েশিয়া, সেস্নাভেনিয়া, যুগোসস্নাভিয়া, মেসিডোনিয়া, গ্রিস, আলবেনিয়া এবং পশ্চিম ইউরোপের অন্যান্য দেশে পৌঁছায়। সম্প্রতি দেখা গেছে, বিশ্বে যে পরিমাণ হেরোইন বিক্রি হয় তার প্রায় অর্ধেকের ক্রেতা ইউরোপ ও রাশিয়া। এ অঞ্চলদ্বয়ে প্রধানত আফগান হেরোইনই আসে। ইউরোপের দেশগুলো বছরে ৮৫ থেকে ৯০ মেট্রিক টন হেরোইন কেনে। এর মধ্যে ক্রয়ের দিক থেকে ৪টি দেশ শীর্ষে, ব্রিটেন (প্রায় ১৯ মেটিক টন/বছর), ইতালি (প্রায় ১৮ মেট্রিক টন/বছর), ফ্রান্স (প্রায় ১০ মেট্রিক টন/বছর) ও জার্মানি (প্রায় ৭ মেট্রিক টন/বছর)।
দড়্গিণ-পশ্চিম এশিয়ার হেরোইন রাশিয়ার জন্য এক বিরাট সমস্যা। রুশ মাদক ব্যবসায়ীরা মধ্য এশিয়ার পথ ব্যবহার করে রাশিয়া ও ইউরোপে হেরোইন পাচার করে থাকে। রাশিয়া বছরে  ৫৮ মেট্রিক টন আফিম এবং ৭০ মেট্রিক টন হেরোইন কেনে। কাজাখস্তান রাশিয়ায় হেরোইন প্রবেশের গেটওয়ে হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
লাতিন আমেরিকায় সবচেয়ে বড় হেরোইন সরবরাহকারী মেক্সিকো ও কলাম্বিয়ার ব্যবসায়ীরা। মেক্সিকোর সঙ্গে স’লসীমানত্ম থাকাটাই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।  মার্কিন  ও মেক্সিকান ব্যবসায়ীরা হেরোইন পাচারে এ সীমান্ত ব্যবহার করে থাকে। বেশিরভাগ সময়ই নারীদের এ কাজে ব্যবহার করা হয়। মেক্সিকান ব্যবসায়ীরা হেরোইন পাচারে ছোট গাড়ি, বাস, ট্রাক ইত্যাদি ব্যবহার করে। শরীরে লুকিয়ে, এমনকি এক্সপ্রেস মেইল সার্ভিসের (ইএমএস) মাধ্যমেও হেরোইন পাচার করা হয়। কলম্বিয়ান কোকেন পাচারকারীরা (হেরোইন আর কোকেন এক জিনিস নয়) তাদের কোকেন পাচারের সময় কিছু হেরোইনও পাচার করে দেয়। যুক্তরাষ্ট্রে উঁচুমানের হেরোইন সরবরাহের জন্য কলম্বিয়ান ব্যবসায়ীদের খ্যাতি রয়েছে। তাদের উৎপাদিত হেরোইন মধ্য আমেরিকা ও মেক্সিকো হয়ে বিমানে করে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছায়। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার, ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র ২০ মেট্রিক টন হেরোইন ক্রয় করেছে। দেশটির সরকারি তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্রের হেরোইনের সিংহভাগই আসে লাতিন আমেরিকার মেক্সিকো ও কলম্বিয়া থেকে। বাকিটা আসে আফগানিসত্মান থেকে (ইউরোপ ও আফ্রিকা হয়ে)।
খুব বেশি পিছিয়ে নেই অস্ট্রেলিয়াও। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড বছরে ১ দশমিক ৮ মেট্রিক টন হেরোইন কেনে। যার পুরোটাই আসে আফগানিস্তান ও বার্মা থেকে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারতকে সবচেয়ে বড় হেরোইন ক্রেতা বলে চিহ্নিত করে জাতিসংঘ। সংস্থাটির ইউএনওডিসির ২০১০ সালের প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে ‘দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া’ এ তথ্য প্রকাশ (২৪ জুন, ২০১০) করে। ভারতে আফিমের চাষও করা হয় বলে ইউএনওডিসির প্রতিবেদনে অভিযোগ আনা হয়; ১ হাজার ৫শ থেকে ২ হাজার হেক্টর জমিতে আফিম চাষ করা হচ্ছে। ২০০৮ সালে ভারতে মোট ১৭ মেট্রিক টন হেরোইন ঢুকেছে, কিন্তু এখন প্রতিবছর দেশটি ৬৫ থেকে ৭০ মেট্রিক টন আফিম ঢুকেছে। ভারতে এখন সীমিত আকারে হেরোইন তৈরি করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতে আফগানিস্তান থেকে আফিম আসে না এবং ভারতের প্রতিবেশী দেশ, যেমন- বাংলাদেশ ও নেপালে আফিম ক্রয়ের পরিমাণ বেড়েছে। শুধু তাই নয় বলা হয়েছে, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিপ্লবীরাও সম্ভবত এই আফিম ও হেরোইন ব্যবসায় লাভবান হয়।
নাইজেরিয়া আফিম কিংবা হেরোইন উৎপাদক নয়। কিন্তু এই দেশটি হেরোইন স্থানান্তর বা যানান্তরের প্রধান ঘাঁটি হিসাবে পরিচিত। নাইজেরিয়া আফ্রিকার মাদক ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রণ করে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। শুধু তাই নয়, নাইজেরিয়ার সংঘবদ্ধ চক্র যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকায় নেশাদ্রব্য সরবরাহ করে থাকে। নাইজেরিয়া একটি হেরোইন স্টেশন হিসাবে ব্যবহৃত হয়, যেখান থেকে এসব অঞ্চলে হেরোইন পৌঁছায়। ১৯৯৭ সালের আগে যুক্তরাষ্ট্রে এক কি দুই পাউন্ড হেরোইন পৌঁছে দিতে নাইজেরিয়ান ব্যবসায়ীরা একজন কুরিয়ারকে ২ হাজার থেকে ৫ হাজার মার্কিন ডলার পরিশোধ করত। ৯০ দশকের শেষের দিকে এসে নাইজেরিয়ান পাচারকারীরা ইএমএস-এর মাধ্যমে সুলভে হেরোইন পাচার শুরু করে। বাচ্চাদের বই, বিভিন্ন পাত্র, মূর্তি ইত্যাদিতে হেরোইন ভরে ইএমএস করা হয়। নাইজেরিয়ানরা প্রায়ই থাইল্যান্ডকে তাদের কাজকর্মের কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহার করে। আফ্রিকা প্রসঙ্গে ইউএনওডিসির (২০১০) বক্তব্য উলেস্নখ করা প্রয়োজন। বলা হয়েছে, ১২ লাখ আফ্রিকান হেরোইনসেবীর জন্য বছরে ২৫ মেট্রিক টন হেরোইন প্রয়োজন হয়। এর সিংহভাগ চাহিদা পূরণ করে আফগানিস্তান। পাকিস্তান, ভারত, দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া  হয়ে আফগান হেরোইন আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে পৌঁছায়। আফ্রিকার দেশ হিসাবে মিসর আফিমের প্রধান গ্রাহক। মিসর বছরে প্রায় ৬০ মেট্রিক টন আফিম কেনে। মিসর  যে বাইরে থেকে আফিম আমদানি করে- এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ধারণা করা যায়, মিসর নিজেই প্রায় ১ হাজার হেক্টর জমিতে আফিম চাষ করে। আফ্রিকায় প্রধান হেরোইন সরবরাহকারী পাকিস্তান। পাকিস্তান আফ্রিকায় বছরে ২০ মেট্রিক টন হেরোইন পাচার করে। আফগান হেরোইনের প্রধান অংশ পাকিস্তান হয়েই আফ্রিকায় পৌঁছায়।

হেরোইন ও বাংলাদেশ


‘ইকোনমিক অ্যান্ড সোস্যাল কমিশন অব এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক’ (ইএসসিএপি) জানিয়েছে, ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশে হেরোইনসেবীর সংখ্যা ছিল ১০ হাজার। কিন্তু বর্তমানে এ সংখ্যা প্রায় ১ লাখ বলে জানিয়েছে ‘দ্য অস্ট্রেলেশিয়ান প্রফেশনাল সোসাইটি অন অ্যালকোহল অ্যান্ড আদার ড্রাগস’ (এপিএসএডি)।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে ইউরোপে হেরোইন পাচারের জন্য বাংলাদেশকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট রুট হিসাবে ব্যবহার করা হয় বলে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বোর্ড (আইএনসিবি) তাদের ২০০৭ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে (প্রকাশকাল : মার্চ, ২০০৮) উল্লেখ করেছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, পাকিস্তান থেকে কুরিয়ারের মাধ্যমে, ভারত থেকে বাণিজ্যিক মোটরযান ও ট্রেনের মাধ্যমে এবং মিয়ানমার থেকে বঙ্গোপসাগর দিয়ে অথবা ট্রাক ও পাবলিক পরিবহনের মাধ্যমে বাংলাদেশে হেরোইন প্রবেশ করে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বিরম্নদ্ধে একটি ঘোরতর অভিযোগ আনা হয়। অভিযোগ করা হয়, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার (বিশেষত পুলিশ) সদস্যদের জনবল এবং যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাবের কারণেই দেশটিতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়ন হতে পারছে না। আরো বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই বাংলাদেশ থেকে অধিকাংশ হেরোইন অন্যান্য দেশের উদ্দেশে পাচার হয় এবং বাকি হেরোইন বেরিয়ে যায় সিলেট ও চট্টগ্রাম বিমানবন্দর দিয়ে। আইএনসিবি লক্ষ্য করে দেখেছে, বাংলাদেশের কুরিয়ার সার্ভিস প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও হেরোইন পাচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ইউএনওডিসির প্রতিবেদনে (২০১০) বলা হয়েছে, জাতিসংঘের তদন্ত দল মাঠ পর্যায়ে তদন্ত শেষে জানতে পেরেছে, নেপালে সীমিত আকারে আফিম চাষ হয়। বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত এলাকাতেও সীমিতভাবে আফিম চাষ হচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই অঞ্চলগুলোর বাজার ধরে রেখেছে মিয়ানমার ও আফগানিস্তানের সরবরাহকারীরা। তারপরও এ দেশগুলো (ভারত, বাংলাদেশ ও নেপাল) যে আঞ্চলিকভাবে আফিমের উৎস হয়ে উঠবে না তা বলা যাবে না এবং এ বিষয়ে আরো গবেষণা প্রয়োজন। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ২০০৮ সালে বাংলাদেশে চার মেট্রিক টন হেরোইন ঢুকেছে।
বাংলাদেশ যে হেরোইনের একটি ট্রানজিট একথা বাংলাদেশের সরকারের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরও মেনে নিয়েছে। তারা তাদের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে জানিয়েছে, দেশের বন ও পাহাড়ি অঞ্চল এবং বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের মাছের ট্রলারগুলো বাংলাদেশে হেরোইন পাচারের নিরাপদ মাধ্যমে হিসাবে ব্যবহৃত হয়। ভারত ও মিয়ানমারের রুট ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় আন্তর্জাতিক মাদক ব্যবসায়ী ও মাফিয়ারা বাংলাদেশ রম্নট বেছে নিয়েছে বলে অধিদপ্তর জানিয়েছে। শুধু তাই নয়, দেশের কোন কোন জেলা ও উপজেলা দিয়ে হেরোইন পাচার হয় সেসব জায়গার তালিকাও ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়।
এ প্রসঙ্গে দুটি প্রতিবেদন উল্লেখযোগ্য, (১) হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ২০ কেজি হেরোইনসহ মারো এলাম উরুগু নামের এক ভারতীয় নাগরিককে গ্রেফতার করা হয়। সে হেরোইন নিয়ে সিঙ্গাপুর যাচ্ছিল (দ্য ডেইলি স্টার : ২০১০, ৫ মে)। (২) তিন মাসে ব্রিটিশ বন্দরে ১০ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের হেরোইন আটক করা হয়েছে। হেরোইনগুলো বাংলাদেশ থেকে অজ্ঞাত মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে পাঠানো হয়েছে। (দ্য গার্ডিয়ান : ২৩ এপ্রিল, ২০০৬)

You can leave a response, or trackback from your own site.