লক্ষ লক্ষ কোষ (cell) দ্বারা গঠিত মানব দেহ সৃষ্টি নৈপুন্যতায় এক জটিল ও অসাধারণ সৃষ্টি। এসব কোষ কিন্তু বিস্তৃত হয়েছে একটি মাত্র কোষ থেকে। জীবনের শুরুতে একটি পুংজনন কোষ, যার নাম শুক্রাণু (sperm), এবং একটি স্ত্রী প্রজনন কোষ যার নাম ডিম্বানু (ovum)। দুই জনন কোষের মিলনকে বলা হয় নিষেক। আল- কোরআনে আল্লাহ সুবহানাতায়ালা বলেন- “ হে মানবজাতি ! কর্তব্যনিষ্ঠ হও তোমাদের প্রভুর প্রতি যিনি তোমাদের সৃস্টি করেছেন একটি মাত্র নাফস থেকে।” ( সূরা নিসা-১)
আরবী “নাফস” শব্দের অর্থ হচ্ছে প্রাণশক্তি, জীবন স্পন্দন। এসব শব্দের অন্তর্নিহিত বিজ্ঞান ভিত্তিক অর্থ হচ্ছে কোষ বা cell.
“ হে মানব সকল ! আমরা তোমাদের সৃষ্টি করেছি পিতৃ ও মাতৃ (জনন কোষ) থেকে।”
(সূরা হুজরাত-১৩)
“ নিশ্চয়ই আমরা মানুষকে সৃস্টি করেছি সংমিশ্রিত নুৎফা থেকে। (সূরা দাহর-২)
বিশেষ দ্রষ্টব্য : আরবী ভাষায় আমরা শব্দটি সম্মানবাচক সর্বনাম অর্থে ব্যবহৃত হয়।
“ আল্লাহ মানুষ কে সৃষ্টি করেছেন নুৎফা থেকে।” (সূরা নাহল-৪)
“অতঃপর নুৎফা কে প্রতিস্থাপন করেছি একটি সুরক্ষিত আধারে যা দৃঢ়ভাবে সংরক্ষিত।”
(সূরা মু’মিনূন-১৩)
আরবী নুৎফা শব্দের দ্বারা Sperm বা Ovum অথবা Sperm/Ovum উভয়কে বুঝানো হয়। নুৎফা শব্দের আরো অনেক অর্থ হতে পারে। যেমন Zygote। একজন ইহুদী পন্ডিত মুহাম্মাদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে জিজ্ঞাস করলেন, হে মুহাম্মাদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, মানুষ কি দ্বারা সৃস্টি হয়েছে ? জবাবে রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, পুরুষ ও নারী উভয়ের নুৎফা থেকে। (মুসনাদে আহমদ)
আল- কোরআন ও ভ্রুণতত্ত্ব ২য় পর্ব
মাতৃগর্ভে একটি মানব শিশু পরিপূর্ণতা লাভ করে স্তরের পর অতিক্রম করে। বৃটিশ ভ্রুণ তত্ত্ববিদ Von bear, ১৮২৭ সালে ভ্রুণ বিকাশের স্তর গুলো আবিস্কার করেন।
৭ম শতাব্দীতে অবতীর্ণ আল-কোরআনে ভ্রুণ বিকাশের পর্যায়গুলো বিভিন্ন সূরায় খন্ডিত ভাবে বর্নিত হয়েছে। যেমন আল- কোরআনে আল্লাহ সুবহানাতায়ালা বলেন- “ তিনি আল্লাহ, যিনি তোমাদের বিভিন্ন স্তর থেকে সৃষ্টি করেছেন। ” (সূরা নূহ-১৪)
“ প্রকৃতপক্ষে আমরা মানুষ সৃষ্টি করেছি মাটির সার নির্যাস থেকে। পরে তা নুৎফা (জাইগোট) রুপে একটি সুরক্ষিত আধারে (জরায়ু) স্থাপন করেছি। অতঃপর তা জমাট রক্তপিন্ডে (জোঁক সদৃশ বস্তু) রুপান্তর করে লটকে দিয়েছি। তারপর লটকে যাওয়া রক্তপিন্ডকে মাংসপিন্ডে পরিণত করেছি। এরপর তাকে অস্থি বানিয়েছি। তারপর অস্থির উপর মাংসপেশী জড়িয়ে দিয়েছি। অবশেষে তাকে একটি ভিন্ন রূপ (পূর্ণশিশু) দান করেছি। সুতরাং তিনি মহামহিম আল্লাহ তায়ালা যিনি সর্বময় মহান স্রস্টা। ” ( সূরা মু’মিনুন, ১২-১৫ ) বিশেষ দ্রষ্টব্য : আরবী ভাষায় আমরা শব্দটি সম্মানবাচক সর্বনাম অর্থে ব্যবহৃত হয়।
“তিনি আল্লাহ যিনি তোমাদের সৃস্টি করেছেন মাটি থেকে, তারপর নুৎফা থেকে তারপর আলাক থেকে, অতঃপর তোমাদের বের করেন একটি পরিপূর্ণ মানব শিশু রুপে।” ( সূরা মু’মিন-৬৭ )
উপরোক্ত আয়াতগুলির বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করে আমরা যা পাই তা হলোঃ মাটির সার নির্যাস বলতে বুঝানো হয়েছে সোডিয়াম (Na), ক্যালসিয়াম (Ca), নাইট্রোজেন (N), পটাশিয়াম (k) ইত্যাদি। বৃক্ষরাজি ও ক্ষেতের ফসল মূলের সাহায্যে এগুলি চুষে নেয়। ফল ও ফসলগুলো মানুষ খাদ্য রুপে গ্রহন করার পর পাকস্থলিতে পরিপাক হয়। সেখান থেকেই পুরুষের শুক্রাশয় (Sperm) এবং নারীর ডিম্বানু (Ovum) উৎপন্ন হয়। অতঃপর Sperm এবং Ovum এর নিষেক থেকে সৃষ্টি হয় জাইগোট (Zygote). জাইগোট জরায়ুতে স্থানান্তরিত হয়ে ভ্রুণ গঠন করে। আর এ ভ্রুণ ক্রমান্বয়ে রুপান্তরের মাধ্যমে একটি পরিপূর্ন মানুষ সৃষ্টি হয়। এখানে জমাট রক্তপিন্ড এর আরবী নাম হল আলাক্ব। বিজ্ঞানে যাকে বলা হয় Blastocyst. এটি দেখতে জোঁকের মত। একটি জোঁক রক্ত চুষে যে রুপ ধারণ করে আলাক সেরকম একটি বস্তু। ৩ থেকে ৪ সপ্তাহের মধ্যে আলাক জোঁক সদৃশ রূপ ধারণ করে। তারপর আলাক মাংসপিন্ডে পরিণত হয়, বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয় Somites. এ প্রক্রিয়া অন্তত ২৩-৪২ দিন পর্যন্ত চলে। এরপর হাঁড় তৈরীর পর্যায় আরম্ভ হয়। প্রথমে যে হাঁড়গুলি দেখা দেয় সেগুলি উপরিভাগের কচি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। তারপর এ কচি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এর উপর মাংসপিন্ড গঠিত হয়ে অস্থি বা কংকালে পরিণত হয়, বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে Skelton. ৮ সপ্তাহের সময় পেশী গুলি হাঁড়ের চারপাশে আবৃত হতে থাকে। ১২ সপ্তাহের মধ্যে ভ্রুণের একটি ক্ষুদ্র পূর্ণাংগ কংকাল গঠিত হয়। এরপর কংকাল এর চারপাশে মাংসপেশী বিস্তার লাভ করে এবং অস্থিগুলো যথাযথ আকার ধারণ করে। এসময় ভ্রুনটি নড়াচড়া করতে সক্ষম হয়।
ভ্রুন বিকাশের প্রতিটি স্তর ৩ টি পর্দা দ্বারা সুরক্ষিত এবং এসব আবরণী ভ্রুণ কে শরীর বৃত্তীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে। এ কথাটিও আল-কোরআনে বলা হয়েছে- “ আল্লাহ তোমাদের সৃষ্টি করেছেন মাতৃগর্ভে এক স্তর থেকে অন্য স্তরে ৩ টি গাঢ় পর্দার ভিতর থেকে। ” (সূরা যুমার-৬)