পারমানবিক অস্ত্র কিভাবে কাজ করে? - প্রযুক্তির আলোয় * আলোকিত জগৎ | The whole technology of light | প্রযুক্তির আলোয় * আলোকিত জগৎ | The whole technology of light

পারমানবিক অস্ত্র কিভাবে কাজ করে?

Print this post
পারমানবিক অস্ত্র

পারমানবিক অস্ত্র

 

পারমানবিক অস্ত্র এ যুগের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় গুলোর মধ্যে একটি যার ভয়াবহতা ও ধ্বংশযজ্ঞ সম্পর্কে আমরা প্রায় সবাই অবগত। কিন্তু এই পারমানবিক অস্ত্র কিভাবে এত বিশাল ধ্বংশযজ্ঞ ঘটায়, সে সম্পর্কে কি আমাদের ধারনা আছে? হ্যাঁ, এখানে মূলত পারমানবিক অস্ত্রের গঠন ও কার্যপ্রণালী সম্পর্ক আলোকপাত করব, কেননা এর তত্ত্বীয় বিষয় গুলো আমাদের প্রায় সকলেরই জানা।

পারমানবিক অস্ত্র সমুহ মূলত দুই ধরনের, ফিশান ও ফিউশন টাইপ। ফিউশন শব্দের অর্থ গলন। অর্থাৎ, দুটি হালকা ভরের ডিউটেরিয়াম বা ট্রিটিয়াম (হাইড্রোজেনের আইসোটোপ) পরমানুর দ্রুত গতিতে মিথস্ক্রিয়ার ফলে তুলনামুলক একটি ভারী পরমানু (হিলিয়াম) ও বিপুল পরিমানে শক্তি উৎপন্ন হয়, একে ফিউশন বিক্রিয়া বলা হয়। আমাদের অতি পরিচিত সূর্য এর উৎকৃষ্ট উদাহরন, যেখানে অনবরত ডিউটেরিয়াম ও ট্রিটিয়াম থেকে হিলিয়াম ও শক্তি উৎপন্ন হয়। এই ফিউশন বিক্রিয়াকে কাজে লাগিয়ে যে অস্ত্র উৎপন্ন করা হয় তাকে বলা হয় থার্মোনিউক্লিয়ার বম্ব, যা হাইড্রোজেন বম্ব(H-Bomb) হিসেবে সুপরিচিত। ১৯৫২ সালে হাংগেরীয় এক কেমিকৌশলী এডোয়ার্ড টেলর সর্বপ্রথম হাইড্রোজেন বোমা আবিস্কার করেন। অন্যদিকে, ফিশানের শাব্দিক অর্থ বিভাজন; অর্থাৎ একটি ভারী পরমানুকে দ্রুতগামী নিউট্রন দ্বারা ভেঙ্গে হালকা ভরের একাধিক পরমানু ও শক্তি উৎপন্ন করার কৌশলই হল ফিশান বিক্রিয়া। জার্মান বিজ্ঞানী অটোহ্যান ও স্ট্র্যাসম্যান এর মূল তত্ত্ব আবিস্কার করেন। পারমানবিক অস্ত্র সমুহের মধ্যে ফিশানই বহুল পরিচিত। যে সকল তেজস্ক্রিয় পদার্থ এই ফিশান ক্রিয়ায় অংশ নেয় তাদের ফিসাইল পদার্থ বা পারমানবিক বিক্রিয়ার জ্বালানী বলা হয়, যেমন ইউরেনিয়াম – ২৩৫ আইসোটোপ অথবা প্লুটোনিয়াম – ২৩৯ আইসোটোপ সমুহ। একটি দ্রুতগামী নিউট্রন ইউরেনিয়াম বা প্লুটোনিয়াম পরমানুকে আঘাত করে কিছু নতুন পরমানু, দুটি নিউট্রন ও প্রচুর পরিমানে শক্তি উৎপন্ন হয়, উৎপন্ন হওয়া পরমানু গুলো আবার নতুন পরমানুকে আঘাত করে বিক্রিয়া চলতে থাকে যতক্ষন না পর্যন্ত জ্বালানী শেষ হয়। তাই একে চেইন বিক্রিয়া বলা হয়। চেইন বিক্রিয়ায় উৎপন্ন শক্তির পরিমান আইনস্টাইনের (নাকি হেনরী পয়েনকারের!) বিখ্যাত ভর-শক্তি সমীকরন (E=mc^2) দ্বারা বের করা যায় যেখানে E হচ্ছে উৎপন্ন শক্তি, m হচ্ছে ভর ও c হল শুণ্য মাধ্যমে আলোর গতিবেগ।

পারমানবিক অস্ত্র উৎপাদনের মূল প্রতিবন্ধকতা হল প্রকৃতিতে প্রাপ্ত তেজস্ক্রিয় মৌলের স্বল্পতা। প্রকৃতিতে ঠিক যে পরিমান ইউরেনিয়াম মজুদ তার ৯৯.২৯ শতাংশ হল ইউরেনিয়াম – ২৩৮ আইসোটোপ, যা দিয়ে পারমানবিক অস্ত্র তৈরী সম্ভব নয় কারন ইউরেনিয়াম -২৩৮ স্বতস্ফুর্ত ভাবে নিউট্রন কণিকা নির্গমন করে ভেঙ্গে যায়। তাই বাকি মাত্র ০.৭৯ শতাংশ প্রকৃতিতে প্রাপ্ত ইউরেনিয়ামকে পৃথক করে বিশুদ্ধ করতেই মূল বাজেটের প্রায় ৯০ শতাংশ খরচ হয়ে যায়। এই পৃথকীকরনের কাজে যে যন্ত্র ব্যবহৃত হয় তার নাম সেন্ট্রিফিউজ, আবার এই যন্ত্র দিয়ে ইউরেনিয়াম -২৩৮ কে প্লুটোনিয়াম-২৩৯ আইসোটোপে পরিনত করা সম্ভব যা ফিসাইল যোগ্য। ২০% বিশুদ্ধ ইউরেনিয়াম -২৩৫ আইসোটোপকে বলা হয় হাইলি এনরিচড ইউরেনিয়াম বা (HEU) এবং ৮০% বা তার অধিক বিশুদ্ধ ইউরেনিয়াম -২৩৫ কে বলা হয় উইপন্স গ্রেডেড ইউরেনিয়াম।

এখন প্রশ্ন থেকে যায়, একটি পারমানবিক অস্ত্র বানাতে কতটুকু ইউরেনিয়াম বা প্লুটোনিয়াম লাগবে? প্রতিটি পারমানবিক অস্ত্র তৈরীতে সর্বনিম্ন যে পরিমান ফিসাইল পদার্থের প্রয়োজন হয় তাকে সংকট ভর বা ক্রিটিক্যাল মাস বলা হয়। অর্থাৎ, এর কম পরিমান ফিসাইল পদার্থ থাকলে নিউক্লিয়ার চেইন বিক্রিয়া শুরু হয়না। এই সংকট ভর ফিসাইল পদার্থের ঘনত্ব, আকৃতি, বিশুদ্ধতা এবং পদার্থটিকে ঢেকে রাখার জন্য যে বহিরাবনের ধাতব আবরন বা শেল ব্যবহৃত হয় তার ওপর নির্ভর করে। এখানে বলে রাখা ভাল, ফিসাইল পদার্থ তেজষ্কৃয় বলে তারা সর্বদা স্বতস্ফুর্ত ভাবে নিউট্রন কণিকা নিঃসরন করে। তাই জ্বালানীর বহিরাবনটি যদি এমন পদার্থের নির্মিত হয় যা উক্ত নিউট্রন কণিকা সমুহকে কোন উপায়ে প্রতিফলিত করতে পারে, তবে জ্বালানীতে নিউট্রন কণিকার ঘনত্ব বেড়ে যাবে ফলে নিউট্রনের সাথে পরমানুর সংঘর্ষের প্রবনতা বৃদ্ধি পাবে। তাই এই বহিরাবনকে রিফ্লেক্টর টেম্পার বলে যা বেরিলিয়াম ধাতুর তৈরী।

সংকট ভরের চেয়ে কম পরিমান ফিসাইল পদার্থকে সাব ক্রিটিক্যাল মাস বা অসংকট ভর এবং সংকট ভরের চেয়ে বেশী পরিমান ফিসাইল পদার্থকে সুপার ক্রিটিক্যাল মাস বা অতিসংকট ভর বলে। বিশুদ্ধ ইউরেনিয়ামের সংকট ভর ৫৬ কিলোগ্রাম ও প্লুটোনিয়ামের বেশ কম, মাত্র ১০ কিলোগ্রাম। অর্থাৎ, একটি পারমানবিক অস্ত্র তৈরী করতে কমপক্ষে ৫৬ কিলোগ্রাম ইউরেনিয়াম অথবা ১০ কিলোগ্রাম প্লুটোনিয়াম লাগবে। এখন অবশ্য মাত্র ৫ কিলোগ্রাম প্লুটোনিয়াম দিয়ে স্যুটকেইস আকারের পারমানবিক বোমা প্রস্তুতি সম্ভব, কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্লুটোনিয়ামের বিশুদ্ধতা অত্যন্ত বেশি।

 

নির্মান কৌশলের দিক দিয়ে ফিশান পারমানবিক অস্ত্র দু’প্রকার, গান টাইপ ও ইমপ্লোশন টাইপ। গান টাইপ পারমানবিক অস্ত্রের কার্যপ্রণালী খুবই সহজ-সরল কিন্তু দক্ষতা খুবই কম, মাত্র ১.৪ শতাংশ। অপরদিকে ইমপ্লোশন টাইপের দক্ষতা ২০ শতাংশের কাছাকাছি।

 

গানটাইপ পারমানবিক অস্ত্রের নির্মানশৈলী অনেকটা বন্দুকের মতন, তাই এর নাম গান টাইপ। একটি লম্বা টিউব, যার গায়ে বেরিলিয়াম মৌলের প্রলেপ লাগানো থাকে, তার দু’প্রান্তে সংকট ভরের চেয়ে কম অর্থাৎ সাব ক্রিটিক্যাল ম্যাসের ফিসাইল পদার্থ ইউরেনিয়াম-২৩৫ রাখা হয়। এক প্রান্তে ইউরেনিয়ামের তৈরি বুলেট ও অপর প্রান্তে একটি নির্দিষ্ট পরিমান ইউরেনিয়াম-২৩৫ জমা থাকে, যাকে বলে টার্গেট। এরপর টিউবের ভেতর সাধারণ বারূদ (কনভেনশনাল এক্সপ্লোসিভ) দিয়ে ইউরেনিয়াম বুলেটকে গতিশীল করা হয় এবং তা অপরপার্শ্বে রক্ষিত টার্গেট ইউরেনিয়ামের সাথে প্রবল বেগে ধাক্কা খায়। সংঘর্ষের পর এরা পরস্পর মিলিত হয়ে সুপার ক্রিটিক্যাল ম্যাস বা অতিসংকট ভর তৈরি করে এবং ফিসাইল পদার্থ হতে নিঃসৃত নিউট্রন কণিকা টেম্পার রিফ্লেক্টরে প্রতিফলিত হয়ে উক্ত ইউরেনিয়াম জ্বালানীকেই আঘাত করে এবং এভাবেই শুরু হয় শৃংখল বিক্রিয়া যার ফলশ্রুতিতে ঘটে পারমানবিক বিস্ফোরণ। ব্যাস তৈরী হয়ে গেল গান-টাইপ পারমানবিক অস্ত্র। জাপানের হিরোসিমায় নিক্ষেপিত ‘লিটল বয়’ ছিলো এই ধরনের অস্ত্র যার শক্তিমাত্রা ছিলো ১৫ কিলোটন টি.এন.টি এবং তাতে ৬৪.১ কিলোগ্রাম বিশুদ্ধ ইউরেনিয়াম ব্যাবহৃত হয়। এ পদ্ধতি সহজ হলেও এর জ্বালানি তথা ইউরেনিয়াম বা প্লুটোনিয়াম খুব বিশুদ্ধ হওয়া প্রয়োজন যা কিনা বহুল ব্যায়সাধ্য, এছাড়া পূর্বেই বলা হয়েছে গান-টাইপের দক্ষতা খুবই কম ও নির্ভর যোগ্য নয়। তাই গান টাইপের চেয়ে ‘ইমপ্লোসন’ টাইপ আরও অনেক বেশি কার্যকর, কিন্তু এর গঠন প্রণালী বেশ জটিল।

 

ইমপ্লোসন টাইপে জ্বালানী হিসেবে ‘পিট’ ব্যাবহৃত হয় যা কিনা লঘু ঘনত্বের ফিসাইল পদার্থ ছাড়া আর কিছুই নয়। এই পিট বিষাক্ত ও ক্ষয়িষ্ণু (করোসিভ ও হ্যাজার্ডাস) বিধায় পিটের চারিপার্শ্বে নিষ্ক্রিয় ধাতু (যেমন স্বর্ণের) পাতলা আবরণ দেয়া হয়, যা গোলাকার আকৃতির। স্বর্ণের পাতলা আবরণ যুক্ত পিট-কে বেরিলিয়াম-অ্যালুমিনিয়াম এর সংকর ধাতু দ্বারা মুড়িয়ে রাখা হয় যা কিনা ফিসাইল পদার্থ হতে নিঃসৃত নিউট্রন কণিকার প্রতিফলক হিসেবে কাজ করে, আগেই বলা হয়েছে-এর নাম টেম্পার রিফ্লেক্টর। এবার সম্পুর্ণ ডিভাইসটিকে কারডাইট বিস্ফোরক বা বারূদের মাঝে রাখা হয়। বহিস্তরের কার্ডাইট বিস্ফোরিত হয়ে শক ওয়েভ বা নিনাদের সৃষ্টি করে যা ভেতরে রাখা অল্প ঘনত্বের পিটকে সংকুচিত করে ফেলে ও এর ঘনত্ব বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে জ্বালানী অতিসংকট ভর বা সুপার ক্রিটিক্যাল মাসে উপনিত হয় এবং জ্বালানী থেকে নিঃসৃত ও টেম্পার রিফ্লেক্টরে প্রতিফলিত হওয়া নিউট্রন কণিকার আঘাতে নিউক্লিয়ার চেইন বিক্রিয়া শুরু হয়। যদি পিটের ভেতর অল্প পরিমানে হাইড্রোজেনের আইসোটোপ (ডিউটেরিয়াম বা ট্রিটিয়াম) ঢুকিয়ে দেয়া হয়, তবে নিউট্রন কণিকা নিঃসরনের মাত্রা বহুলাংশে বেড়ে যায় এবং অধিক ধংশযজ্ঞ সম্পন্ন হয়, একে ‘বুস্টিং’ বলে। ইমপ্লোসন টাইপ পারমানবিক অস্ত্র ‘হাই এনরিচড ইউরেনিয়াম’ জ্বালানী হিসেবে ব্যাবহৃত হয়। ফলে স্বল্প পরিশোধিত ইউরেনিয়াম বা প্লুটোনিয়াম দ্বারা এ ধরনের পারমানবিক অস্ত্র প্রস্তুত সম্ভব, আর এ কারনেই ইমপ্লোসন টাইপ পারমানবিক অস্ত্র বেশি জনপ্রিয়! জাপানের নাগাসাকিতে নিক্ষেপিত “ফ্যাট ম্যান’ এ ধরনের পারমানবিক অস্ত্র ছিলো।

 

স্নায়ু যুদ্ধের সময় থেকেই মূলত পারমানবিক অস্ত্র তৈরির প্রতিযোগীতা শুরু হয়েছিল বৃহৎ শক্তিবর্গের মধ্যে, কিন্তু স্নায়ু যুদ্ধের পরবর্তিতেও কিছু যুদ্ধোন্মাদ নেতারা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার খোঁড়া অজুহাত তুলে শত কোটি টাকা অপচয় করে একের পর এক পারমানবিক যুদ্ধাস্ত্র তৈরী করে বিশ্বশান্তিকে চরম হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। যারা ইস্রায়েলের আগ্রাসী পারমানবিক প্রকল্পের কথা জেনেও চোখ বন্ধ করে রাখে কিন্তু ইরানের শান্তিপূর্ণ পারমানবিক প্রকল্পে বাধা দেয় ও মিথ্যা অজুহাত তুলে বিভিন্ন দেশ আক্রমন করে, তারাই এখন বিশ্বে এককভাবে পারমানবিক যুদ্ধাস্ত্রের মালিক এবং গোটা বিশ্বের নিয়তী এসব অর্ধোন্মাদ নেতাদের হাতের মুঠোয়। তাই এখন থেকেই আমরা সচেতন না হলে অদুর ভবিষ্যতে আমাদের এই প্রিয় সবুজ পৃথিবী একদিন ঊষর, বন্ধ্যা ও তেজষ্কৃয়তায় পরিপূর্ণ এক নির্জীব গ্রহে পরিনত হবে, যাতে থাকবেনা কোন প্রাণের স্পন্দন।।

 

 

 

পোষ্টটি লিখেছেন “চতুর্থ মাত্রা”

You can leave a response, or trackback from your own site.