রোবটের মাথায় জীবন্ত কোষ - প্রযুক্তির আলোয় * আলোকিত জগৎ | The whole technology of light | প্রযুক্তির আলোয় * আলোকিত জগৎ | The whole technology of light

রোবটের মাথায় জীবন্ত কোষ

Print this post

রোবট তৈরির ক্ষেত্রে চাঞ্চল্য ফেলে দিয়ে ছিলেন বিজ্ঞানীরা ৷ তারা এমন রোবট তৈরি করেছেন যার মাথায় রয়েছে বায়োলজিক্যালব্রেইন ৷ ফলে রোবটটি নিজেই নিজেকে পরিচালিত করতে পারে৷ তার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বাইরে থেকে কমপিউটারভিত্তিক কোনো কমান্ড দেয়ার প্রয়োজন হয় না৷ কোনো সমস্যা হলে নিজেই নিজের ডাক্তারের ভূমিকা নিতেও সক্ষম এই রোবট৷ এ পর্যায়ে রোবটটির নাম দেয়া হয়েছে গর্ডন৷ আর এটি তৈরি করেছেন যুক্তরাজ্যের রিডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা৷

রোবটের মধ্যে বায়োলজিক্যালব্রেইন হিসেবে তারা ব্যবহার কছেন ইঁদুরের মস্তিষ্কের কোষ৷ আর এই কোষ থেকে সঙ্কেত পাওয়ার ভিত্তিতেই কাজ করছে গর্ডন৷ বিজ্ঞানীরা রোবটের মধ্যে ইঁদুরের তিন লাখ স্নায়ুকোষ স্থাপন করেছেন৷ এই স্নায়ুকোষ একটি সোলারের (প্রতিফলিত শব্দতরঙ্গের সাহায্যে পানিতে নিমজ্জিত বস্তুর সন্ধান ও তার অবস্থান নির্ণয় করার যন্ত্র) মাধ্যমে রোবটকে দিকনির্দেশনা দেবে৷

প্রাথমিক পর্যায়ে এখন এসব স্নায়ুকোষকে শেখানো হচ্ছে যে কীভাবে গর্ডন তার চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করবে এবং কীভাবে নিজের চলার পথের সব প্রতিবন্ধকতা দূর করবে৷ আশেপাশের পরিবেশ সম্পর্কেও স্নায়ুকোষগুলোর থাকবে সুস্পষ্ট ধারণা৷ ইঁদুরের মস্তিষ্কের শ্বেত পদার্থের বহিরাবরণ নিয়ে রোবটটির মস্তিষ্ক তৈরি করা হয়েছে৷ স্নায়ুকোষগুলো জীবন্ত থাকায় বিদ্যুত্বাহী যন্ত্রপাতির সাথে এদেরকে না রেখে একটি পৃথক তাপনিয়ন্ত্রিত কেবিনে রাখা হয়েছে৷

এবারই যে প্রথম রোবটে জীবন্ত স্নায়ুকোষ ব্যবহার হলো তা নয়৷ রিডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের আগে ২০০৩ সালে জর্জিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির বিজ্ঞানী ড. স্টিভ পটার প্রথমবারের মতো রোবটের মস্তিষ্কে ইঁদুরের স্নায়ুকোষ ব্যবহার করেন৷ তার রোবটের নাম দেয়া হয় হাইব্রটস৷

রিডিং বিশ্ববিদ্যালরে বিজ্ঞানী ড. বেন হোয়েলে বলেছেন, ইঁদুরের স্নাযুকোষ সংযোজনের ফলে রোবটের আচরণে ভিন্ন মাত্রার পরিবর্তন আসবে এটা নিশ্চিত৷ এই পরিবর্তনটা ঠিক কেমন হবে তা এখনই বলে দেয়া সম্ভব নয়৷ এজন্য আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন হবে৷ তিনি বলেন, মূলত ব্রেইন টিস্যু বা মস্তিষ্কের কোষ স্থাপনের মাধ্যমে গর্ডনকে বায়োলজিক্যাল ব্রেইনের ভেতর দিয়ে নিজ সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম করে তোলা হয়েছে৷ এ কাজে ব্যবহার করা হয়েছে ইঁদুরের নিউরন৷

তিনি বলেন, মস্তিষ্কের কোষসমূহ রোবটে ব্যবহারের জন্য তৈরি করতে হয়েছে নিউরন সক্ষম মেশিন৷ এর মাধ্যমে সত্যিকার অর্থে ব্রেইন টিস্যু আদলে রোবটটিকে তৈরি করা হয়েছে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সক্ষমরূপে৷

গবেষণাকারী দলের প্রধান কেভিন ওয়ারউইক বলেন, তাদের এই গবেষণার মাধ্যমে মূলত দেখার চেষ্টা করা হয়েছে যে, বায়োলজিক্যাল ব্রেইন রোবটে প্রতিস্থাপন করা হলে তা ঠিকমতো কাজ করে কিনা তা দেখা৷ এটি করতে গিয়ে উদ্ভাবন করতে হয়েছে বিশেষ ধরনের প্রযুক্তি৷ কারণ ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি এবং জীবন্ত স্নায়ুকোষের সহাবস্থান সহজ কাজ নয়৷ কোষ রাখার জন্য তাই উদ্ভাবন করতে হয়েছে বিশেষ মেশিন৷ তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করেছি ব্রেইন টিস্যু রোবটের মধ্যে স্থাপনের মাধ্যমে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ নিউরন রোবটের মস্তিষ্করূপে কর্মক্ষম করার৷ এটি সফল হলে ভবিষ্যতে বায়োলজিক্যাল ব্রেইন সমৃদ্ধ হওয়ায় এই মস্তিষ্ক ব্লু-টুথ রেডিও লিঙ্কের মাধ্যমে রোবটের দেহকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে৷ কোষ হিসেবে প্রথম পর্যায়ে ইঁদুরের ব্রেইন থেকে কোষ নেয়া হয়েছে৷ ভবিষ্যতে আমাদের গবেষণায় মানুষের মস্তিষ্কের কোষ সংযোজনের মাধ্যমে সত্যিকার অর্থে বুদ্ধিমত্তাসমৃদ্ধ রোবট তৈরির গবেষণায় সফলতা অর্জিত হবে বলে তার বিশ্বাস৷

রোবট গর্ডনে ইঁদুরের যে মস্তিষ্কের কোষ ব্যবহার করা হয়েছে তা ১ কোটি নিউরনের সমন্বয়ে তৈরি করা হয়েছে৷ পরবর্তীতে গবেষণায় সফল্য অর্জিত হলে মানুষের মস্তিষ্কের কোষ সংযোজনের যে পরিকল্পনা রয়েছে তা হবে ১০ হাজার কোটি নিউরনের সমন্বয়ে তৈরি৷ তখন হয়ত পাওয়া যাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ যন্ত্রমানব৷

বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস জীববিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির মধ্যে যে ব্যবধান রয়েছে তাতে সেতুবন্ধন তৈরিতে ভূমিকা রাখবে নতুন উদ্ভাবিত রোবট গর্ডন৷ মস্তিষ্কের কোষ থেকে তৈরি বৈদ্যুতিক সঙ্কেত ধরার জন্য গর্ডন ব্যবহার করছে ৬০টি ইলেকট্রোড৷ ওই কোষের থেকে আসা সঙ্কেতের ভিত্তিতেই রোবটটি নড়াচড়া করতে সক্ষম হয়৷

গবেষকরা জানান, গর্ডন যখন কোনো বস্তুর কাছে থাকে তখন তার মস্তিষ্কের ইলেকট্রোড থেকে সঙ্কেতের ভিত্তিতে সে বুঝতে পারে তার পরবর্তী কর্মকা ঠিক কি হবে৷ সেই সঙ্কেতের ভিত্তিতেই সে তার চাকার মাধ্যমে ডানে বা বামে সরে যায়৷ উত্তপ্ত কোনো বস্তু থাকলে সেটাও সে চিহ্নিত করতে পারে এবং এটিকে কিভাবে পাশ কাটিয়ে যেতে হবে তাও নির্ধারণ করতে পারে৷ মানুষ বা কমপিউটার এটি নিয়ন্ত্রণ করছে না৷ সম্পূর্ণ স্বনির্ধারণী পদ্ধতিতে পরিচালিত হচ্ছে রোবটটি৷ তার মস্তিষ্কের কোষ যেমন সঙ্কেত দিচ্ছে সেও সেই অনুযায়ীই কাজ করছে৷

বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব সিস্টেমস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কেভিন ওয়ারউইক বলেন, বায়োলজিক্যাল ব্রেইন একটি রোবটকে পরিচালিত করছে এ বিষয়টি সত্যি উত্তেজনাকর৷ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীভিত্তিক চলচ্চিত্রে এমন দেখা গেলেও বাস্তবতা রয়েছে তা থেকে বহুদূরে৷ এই গবেষণা সেই বহুদূরকে নিয়ে এসেছে একেবারে কাছাকাছি৷ মস্তিষ্ক কিভাবে শিক্ষা নেয় এবং কিভাবেই বা অভিজ্ঞতা স্মরণ করে তা খুঁজে বের করতেও এই গবেষণা সহায়ক হবে৷ তিনি বলেন, চলতি গবেষণা মস্তিষ্কের কার্যক্রম সম্পর্কে বুঝতে ও জনতে বিজ্ঞানীদের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে সহায়তা করবে৷ ফলে ভবিষ্যতে বিজ্ঞান এবং চিকিত্সার বহু খাতে প্রভূত উন্নয়ন সাধিত হবে৷ গবেষকরা এখন রোবটটিকে বিভিন্ন সঙ্কেত শিক্ষা দিচ্ছেন৷ একই সাথে দেখা হচ্ছে রোবটটি ঠিকমতো সঙ্কেত ধরে কাজটি করতে পারে কিনা সেদিকে৷ এই গবেষণার পথ ধরেই জানা যাবে, মস্তিষ্কে তথ্য কিভাবে সংরক্ষিত থাকে৷ আশা করা হচ্ছে এই পর্যবেক্ষণ আলঝেইমার্স, পারকিনসন্স, স্ট্রোক এবং মস্তিষ্কের আঘাতজনিত রোগ চিকিত্সায় তাত্পর্যপূর্ণ অগ্রগতি বয়ে আনবে৷ গর্ডন প্রকল্পে অর্থ যোগান দিচ্ছে যুক্তরাজ্যের ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ফিজিক্যাল সায়েন্সেস রিসার্চ কাউন্সিল৷

বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসিস্ট এবং গর্ডন নির্মাণ দলের সদস্য বেন হোয়েলে বলেছেন, মস্তিষ্কের কোষের জটিল অবস্থার মধ্যে স্বতন্ত্র নিউরনের কার্যক্রমসমূহের সংযোগ স্থাপন কিভাবে করা যাবে সেটাই বিজ্ঞানীদের কাছে এখন অন্যতম মৌলিক প্রশ্ন৷ আর এই গবেষণা এ প্রশ্নের জবাব খুঁজে বের করার এক অসাধারণ সুযোগ বয়ে এনেছে৷ আশা করা যায়, যেসব মৌলিক প্রশ্নের সমাধানের জন্য আটকে আছেন বিজ্ঞানীরা, তার নিষ্পত্তি হবে শিগগিরই৷ এর আগে ২০০৫ সালে বায়োলজিক্যাল সিস্টেমে অনুপ্রাণিত হয়ে বিজ্ঞানীরা তৈরি করেছেন মিনিয়েচার বা ক্ষুদ্র রোবট৷ এই রোবটরা নিজেদের ভুল ধরতে এবং বিষয়টি সংশোধন করতে পারে৷ যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুয়েটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি) এই রোবট নিয়ে আরো গবেষণা অব্যাহত রয়েছে৷ গবেষণা দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন জোসেফ জ্যাকবসন৷

সবকিছু মিলিয়ে একথা বলা যায়, রোবট গবেষণা বহুদূর এগিয়ে গেছে৷ যন্ত্র এবং জীব কোষের মধ্যে ঘটছে মিথষ্ক্রিয়া৷ এ সুফল নিশ্চয়ই পাবে মানুষ৷ এজন্য এখন শুধু অপেক্ষার পালা৷

পোষ্টটি  লিখেছেন চতুর্থ মাত্রা”

You can leave a response, or trackback from your own site.