আটলান্টিক মহাসাগরের একটি বিশেষ অঞ্চল বারমুডা ট্রায়াঙ্গল। এটিকে পৃথিবীর অন্যতম রহস্যময় স্থান বলে মানা হয়। কারণ এ পর্যন্ত এখানে যত রহস্যময় ও কারণহীন দুর্ঘটনা ঘটেছিল, অন্য কোথাও এত বেশি দুর্ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি করা হয়। ‘এলেন অস্টিন’ জাহাজটির কথাই ধরা যাক। মধ্য আটলান্টিকে পাড়ি দেওয়ার সময় এলেন অস্টিন জাহাজের নাবিকরা একটু দূরে একটি খালি জাহাজ ভাসতে দেখে ভীষণ অবাক হন। ঠিক করলেন, নিজের জাহাজের মাঝি-মাল্লাদের পাঠিয়ে একটু দেখে আসা যাক। পাঠালেনও সেই মতো। মাঝিরা জাহাজের কাছাকাছি পেঁৗছতেই ঘনকুয়াশা চারদিক ঢেকে গেল। কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
কি হলো? কিছুক্ষণ পর আস্তে আস্তে কুয়াশা কেটে গেল। খালি জাহাজটি দেখা গেল। কিন্তু মাঝি-মাল্লারা গেল কোথায়? তারা তো ফিরছে না!ঘটনার রহস্য সমাধান করতে আরও একটি দলকে পাঠানো হলো। ওই দলটিও জাহাজে পেঁৗছামাত্র শুরু হলো প্রচণ্ড ঝড়। এবারও কিছুই দেখা গেল না। ঝড় থামার পর দেখা গেল সব ভ্যানিশ।
মাঝি-মাল্লাদের আর দেখা গেল না। এমনকি জাহাজটিও কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে! চারদিকে তোলপাড় পড়ে গেল। চলল অনেক খোঁজাখুঁজি। কিন্তু কোথাও এর কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া গেল না। বারমুডা ট্রায়াঙ্গল বা শয়তানের ত্রিভুজের রহস্য এমনই। এখানে কোনো বিমান কিংবা জাহাজ হারিয়ে গেলে তার ধ্বংসাবশেষ কোনো চিহ্নও খুঁজে পাওয়া যায় না।
এখানে কোনো মৃতদেহ ভাসতে দেখা যায় না। কোনো কিছুরই নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায় না। এই ত্রিভুজ অঞ্চলে এমন অদ্ভুতভাবে হারিয়ে গেছে মানুষ, জাহাজ কিংবা উড়োজাহাজ। এরকম অসংখ্য অন্তর্ধানের গল্প বারমুডা ট্রায়াঙ্গলকে পৃথিবীর সেরা রহস্যাবৃত অঞ্চলে পরিণত করেছে। অনেকে মনে করেন, এসব অন্তর্ধানের কারণ নিছক দুর্ঘটনা, যার কারণ হতে পারে প্রাকৃতিক দুর্যোগ অথবা চালকের অসাবধানতা।
আবার চলতি উপকথা অনুসারেএসবের পেছনে দায়ী অতি-প্রাকৃতিক কোনো শক্তিবা ভিনগ্রহের প্রাণীর উপস্থিতি। জায়গাটির রহস্যময়তা নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে, বানানো হয়েছে অসংখ্য ডকুমেন্টারি। পক্ষে-বিপক্ষে অনেক কথা শোনা যায়। আবার যেসব দুর্ঘটনার ওপর ভিত্তি করে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলকে চিহ্নিত করা হয়েছে তার বেশ কিছু ভুল, আবার অনেক কিছুই লেখক দ্বারা অতিরঞ্জিত বলে মনে করা হয়।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গল আসলে কি? ক্যারিবীয় সাগরের এক কল্পিত ত্রিভুজ এলাকা হলো শয়তানের ত্রিভুজ। আটলান্টিক মহাসাগরের তিন প্রান্ত দিয়ে সীমাবদ্ধ ত্রিভুজাকৃতির একটি বিশেষ এলাকা যেখানে বেশ কিছু জাহাজ ও উড়োজাহাজ রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হওয়ার কথা বলা হয়। এর মূল নাম বারমুডা ট্রায়াঙ্গল। তবেএর কুখ্যাতির জন্য একে শয়তানের ত্রিভুজ বলা হয়। বারমুডা ট্রায়াঙ্গল যে তিনটি প্রান্ত দ্বারা সীমাবদ্ধ তার এক প্রান্তে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা, আরেক প্রান্তে পুয়ের্তো রিকো এবং অপর প্রান্তে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বারমুডা দ্বীপ অবস্থিত।
ত্রিভুজাকার এ অঞ্চলটির মোট আয়তন ১১৪ লাখ বর্গ কিলোমিটার বা ৪৪ লাখ বর্গ মাইল। এটি ২৫-৪০ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ এবং ৫৫-৫৮ ডিগ্রি পশ্চিম দ্রাঘিমাংশের মধ্যে অবস্থিত। অবশ্য এই বিন্দু নির্ধারণ নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। বেশিরভাগ লেখক-গবেষকই এই নির্দিষ্ট অঞ্চলকে চিহ্নিত করেছেন সীমানা বরাবর মিয়ামি, সানজুয়ান, পুয়ের্তো রিকো, মধ্য আটলান্টিক আর বারমুডা নিয়ে তৈরি একটি ত্রিভুজ বা বলা ভালো একটি ট্রাপিজিয়াম আকৃতির চতুর্ভুজ। তবে বেশিরভাগ হারিয়ে যাওয়ার ঘটনাগুলো ঘটেছে দক্ষিণ সীমানায় বাহামা দ্বীপপুঞ্জ ঘিরে এবং ফ্লোরিডা উপকূলের আশপাশে।
বিভিন্ন লেখকের বর্ণনায় বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের বিস্তৃতিতে ভিন্নতা রয়েছে। এই ত্রিভুজের ওপর দিয়ে মেক্সিকো উপসাগর থেকে উষ্ণ সমুদ্র স্রোত বয়ে গেছে। এখানকার আবহাওয়া এমন যে, হঠাৎ ঝড় ওঠে আবার থেমে যায়, গ্রীষ্মে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। এ অঞ্চল বিশ্বের ভারী বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলকারী পথগুলোর অন্যতম। জাহাজগুলো আমেরিকা, ইউরোপ ও ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে যাতায়াত করে। এছাড়া এটি হলো প্রমোদতরীর বিচরণক্ষেত্র। এ অঞ্চলের আকাশপথে বিভিন্ন রুটে বাণিজ্যিক ও ব্যক্তিগত বিমান চলাচল করে। ত্রিভুজের বিস্তৃতির বর্ণনায় বিভিন্ন লেখক বিভিন্ন মতদিয়েছেন।
কেউ মনে করেন, এর আকার ট্রাপিজয়েডের মতো, যা ছড়িয়ে আছে স্ট্রেইটস অব ফ্লোরিডা, বাহামা এবং ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ এবং ইশোর (অুড়ৎবং) পূর্ব দিকের আটলান্টিক অঞ্চলজুড়ে। আবার কেউ কেউ এগুলোর সঙ্গে মেক্সিকো উপসাগরকেও যুক্ত করেন। তবে লিখিত বর্ণনায় যে সাধারণ অঞ্চলের ছবি ফুটে ওঠে তাতে রয়েছে ফ্লোরিডার আটলান্টিক উপকূল, সান জুয়ান , পুয়ের্তো রিকো, মধ্য আটলান্টিকে বারমুডার দ্বীপপুঞ্জ এবং বাহামা ও ফ্লোরিডা স্টেইটসের দক্ষিণ সীমানা। আর এখানেই ঘটেছে অধিকাংশ দুর্ঘটনা।এ অঞ্চলের রহস্যময়তার একটি দিক হলো, কোনো জাহাজ এ ত্রিভুজ এলাকায় প্রবেশ করার কিছুক্ষণের মধ্যেই বেতার তরঙ্গ প্রেরণে অক্ষম হয়ে পড়ে এবং এর ফলে জাহাজটি উপকূলের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে ব্যর্থ হয়। একসময় তা দিক নির্ণয় করতে না পেরে রহস্যজনকভাবে অদৃশ্য হয়ে যায়।
সেই কলম্বাসের সময় থেকে শুরু করে এখনো এখানে ঘটছে একই ব্যাপার। এখানে এখনো হারিয়ে যায় জাহাজ, সাবমেরিন কিংবা বিমান। নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় সবকিছু। এর নামই বারমুডা ট্রায়াঙ্গল। বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের অভ্যন্তরে আছে শ’তিনেক কোরাল দ্বীপ। এর বেশির ভাগই জনবসতিহীন। আর এর মধ্যে একটি দ্বীপ হচ্ছে ‘বারমুডা’। দ্বীপটি আবিষ্কৃত হয় ১৫৬৫ সালে। এক দুঃসাহসী নাবিক জুয়ান ডি বারমুডেজ দ্বীপের আবিষ্কারক। তার নামানুসারেই এই দ্বীপের নামকরণ করা হয়। এ এলাকার ধার ঘেঁষে গেলেও দেখা যায় অদ্ভুত কিছু কাণ্ড-কারখানা। মাঝে মাঝে নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্র বাতিল করে দেয়, রেডিও বিকল করে দেয়, কম্পাস ইত্যাদির বারোটা বাজিয়ে দেয়। ক্ষুদ্র আলোক শিখা, ধূমকেতুর পুচ্ছ, সবুজ রঙের কুয়াশা, বিদঘুটে জলস্তম্ভ, প্রচণ্ড ঘূর্ণিপাক, পথ ভুলে যাওয়া, হিংস ভাবে জাহাজ গিলতে আসা পাহাড় সমান ঢেউসহ ভয়ঙ্কর সব কাণ্ড-কারখানা। আবার এক মাস আগে যে জাহাজ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে সে জাহাজকেও ভুতুড়েভাবে ভাসতে দেখা যায় এখানে।
লিখেছেন