ইতালির পিসা শহরে ১৫৬৪ সালে এক দরিদ্র পরিবারে গ্যালিলিও গ্যালিলি জন্মগ্রহন করেন। পিসা শহরেই তিনি চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে লেখাপড়া করতেন। একদিন গ্যালিলি আচমকা জ্যামিতি বিষয়ে একটি বক্তৃতা শুনেন। এই ঘটনাই তার জীবনের গতিপথ বদলে দেয় এবং পৃথিবীর ইতিহাসে এক নতুন দিগন্তের সূচনা হয়।
চিকিৎসাশাস্ত্র ছেড়ে গ্যালিলি এবার অংক নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলেন। কিন্ত দারিদ্রতার জন্য তার বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা বেশীদূর এগুলো না। মাঝপথেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দিলেন। কিন্ত ইতোমধ্যে তিনি ভৌতবিজ্ঞানের সূত্রগুলির ওপর কিছু অসাধারন তত্ত্ব ও চিন্তাভাবনা প্রকাশ করেন। ফলে ইতালীর বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে তিনি একের পর এক শিক্ষকতার চাকরি পেতে থাকেন।
জীবনের প্রথম দিকেই গ্যালিলি নিশ্চিত হয়েছিলেন, দুই সহস্রাধিক বছরের পুরনো টলেমির নীতিটি একেবারেই ভ্রান্ত। টলেমির সূত্রটি হলো,”সূর্য পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরে””। কিন্ত সেই মধ্যযুগে টলেমির বিপরীত ধারণা পোষন করার অর্থ ধর্মদ্রোহিতা। সুতরাং গ্যালিলিও এ বিষয়ে জনসমক্ষে কোন উচ্চবাচ্য করলেন না।
১৬০৯ সালের বসন্তে তিনি পদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছিলেন। সেই সময় তিনি শুনে পান, হল্যান্ডে একটি নতুন যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়েছে, যার নাম টেলিস্কোপ। যার সাহায্যে দূর আকাশের অনেক কিছুই দেখা যায়। গ্যালিলি টেলিস্কোপ যন্ত্রটিকে ঢেলে সাজালেন, আরও উন্নত করে তুললেন।
এবার সেই যন্ত্র দিয়ে তিনি আকাশ পর্যবেক্ষণ শুরু করলেন, পৃথিবী থেকে প্রথমবারের মতো অনেক নতুন জিনিস তিনি দেখতে পেলেন যা এর আগে আর কারো চোখে ধরা পড়েনি! শনিগ্রহের বলয়গুলোও প্রথম সুস্পষ্টভাবে তার চোখেই ধরা পড়লো। সূর্যের চারপাশে কয়েকটি বিন্দুর আবর্তন দেখে তিনি নিশ্চিত হলেন কোপার্নিকাসের তত্ত্বই সঠিক। পৃথিবী আদৌ সৌ্রজগতের কেন্দ্র নয়, এ-কথা জানাবার সময় হয়ে গেছে। বহুবার তিনি রোমে গেলেন পোপের কাছ থেকে অনুমতি নিতে। শেষ পর্যন্ত ১৬২৪ সালে পোপের কাছ থেকে অনুমতিও পেলেন। ‘জগতের অবস্থা’ বিষয়ে গ্যালিলিও এখন কোপার্নিকাস ও টলেমি দু’জনের তত্ত্বই আলোচনা করতে পারবেন।
১৬৩২ সালে তার ‘ডায়ালগ “কনসার্নিং দ্য টু চিফ ওয়ার্ল্ড সিস্টেমস’” প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে সমস্ত ইউরোপে এটি এক গুরুত্বপূর্ণ আধুনিক দর্শন ও বিজ্ঞানের গ্রন্থ বলে স্বীকৃত হলো। কিন্তু গ্যালিলিওকে এর চরম মূল্য দিতে হলো। রোমান ক্যাথলিক চার্চ তখনও প্রোটেস্টান্ট সংস্কারের আঘাত কাটিয়ে উঠতে পারেনি, ধর্মযাজকরা ঘোষনা করলেন , “লুথার এবং ক্যালভিনের সমষ্টিগত অপরাধের চেয়েও গ্যালিলির একার অপরাধ ধর্মের পক্ষে আরো বেশি ক্ষতিকারক ।” রোম শহরে একটি জাল দলিল পাওয়া গেল, এই দলিলে না কি বলা হয়েছে গ্যালিলিও যেন কোনভাবেই কোপার্নিকাসের তত্ত্ব আলোচনা না করেন।
গ্যালিলিওকে গ্রেফতার করে অভিযুক্ত করা হলো, তাকে দেখানো হলো শারিরীক অত্যাচারের ভয়। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো, ফ্লোরেন্সে তার নিজ বাড়িতে তাঁকে অন্তরিন অবস্থায় বাকি জীবন কাটাতে হবে। এত কিছু সত্ত্বেও তিনি দমলেন না, তিনি একের পর এক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে লাগলেন। এসব পরীক্ষায় তিনি যেসব সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন সেগুলি লিখে রাখলেন। শেষ করলেন তার বই “‘ডায়ালগ কনসার্নিং দ্য টু নিউ সায়েন্সেস’”। এই বইয়ে গ্যালিলিও পদার্থবিজ্ঞান ও বলবিদ্যা নিয়ে তাঁর যাবতীয় চিন্তাধারা লিপিবদ্ধ করেছেন। ১৬৩৮ সালে প্রোটেস্টান্টরা হল্যান্ড থেকে এই বইটি প্রকাশ করেন।
এর চার বছর পর ৭৮ বছর বয়সে অন্ধ হয়ে অন্তরিন অবস্থাতেই গ্যালিলিওর মৃত্যু হয়। কিন্ত ততদিনে তিনি জেনে গেছেন, “এই বিশ্ব, এই জগৎ, এই পৃথিবী আর আগের অবস্থায় নেই। প্রাচীনযুগের গন্ডি পেরিয়ে এই পৃথিবী এগিয়ে গেছে আরো অনেক….অনেক দূর! ”
গ্যালিলিও সম্পর্কে লিখতে হলে অনেক কিছুই লিখতে হয়। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে এই তথ্যগুলো একীভূত করতে পেরেছি।